Tuesday, February 6, 2018

ক্যানভাস ৩



।। কথামুখ।।

"স্ফুলিঙ্গ "এর ওয়েবজিন 'ক্যানভাস' তৈরি হলো সময়ের দাবি মেনে। কিন্তু পত্রিকার কাগজ-সংস্করণও বেরোবে সময়মত। সাহিত্যের একটা সুদীর্ঘ ক্যানভাস  বানানো আমাদের লক্ষ্য। যেখানে বরাক উপত্যকা সহ উত্তর-পূর্ব, পশ্চিমবঙ্গ,  বাংলাদেশের বন্ধুরা থাকবেন। তাঁদের নানা রঙের রচনায় রঙিন হবে ক্যানভাস। আর আমদের মন।
তাই সংগে থাকুন। আপনাদের মতামত জানান। পাঠান লেখাও।

বিঃ দ্র ঃ আমাদের পণ্ডিতি শুচিবায়ু নেই। 


কবিতা

ভাল না বাসার গল্প 

প্রিয়াংকা চৌধুরী মুখোপাধ্যায় 

১ 

তোমাকে ভাল লাগে। যখন তুমুল হই তীব্র আশ্লেষে, তারপর আর ভাল লাগেনা। ঝড়ের পরবর্তী শান্ত দীঘির পাড়ে এসে। 

যেমন চায়ের কাপে বাসি গন্ধ আসে, ধোঁয়া ওঠা চায়ের শেষে ।।  

২ 
তোমায় আমি ঘেন্না করি। হ্যাঁ । ঘেন্না করি । 
ভালোবাসার গল্প যদি বলতে পারি,
ঘেন্না করার গল্প কেন পারিনা ! 
তোমার গায়ের গন্ধ আমার ভাল্লাগেনা।


দু চুমুক চা


কবীর দেব

“কিরে বুঝলি?” জবাব চাইল সে,

ঘন মেঘে ঢাকা গলার তলায় জবাব থেমে রইল।

আস্তে আস্তে বললুম, “না রে আর বুঝতে চাই না”

চাঁদের মতো তার চোখে নেমে এল একটা সরু টান।

উসকানো চুলকে নির্দিষ্ট জায়গাতে নিয়ে জিজ্ঞেস করল,

“কেন? তোর আবার কি হল”

ঝড়ের মত সিগারেটের ধোঁয়া ছেড়ে জবাব দিলুম

“আজ এই রাস্তা দিয়ে কত পথ এসে হাজির হলাম দেখ,

কাল যদি এই রাস্তার শিরা কেটে আরো কোথাও নিয়ে যায়,

শরৎ কালের দৃশ্যের যায়গায় শহরের উঁচু বাড়ি দিয়ে বন্দি হয়ে পড়িস

তর কাছে কেউ সিগারেট দেখে খারাপের ইতিহাস বলে ফেলল,

শ্রাবণ মাসের চাঁদের আলোর মধ্যে কি বুঝতে চাইবি, না ভাবতে চাইবি?”

থমকে দাঁড়িয়ে মুচকি হেসে হাঁটা আবার শুরু করলাম,

স্তব্ধতা দিয়ে গুন গুন করে আমরা এইবার ভাবলাম,

বাড়ি ফিরে আমরা দুজনে মিলে চায়ে চুমুক দিয়ে কবিতা লিখলাম,

ও বলল, “বিরতি নিয়ে মন্দ করি নাই”।




দাহ

রাজেশ চন্দ্র দেবনাথ

যজ্ঞের চিতায় দাহ শেষে
পোড়া কলা চেটে নেয় সম্পর্কের কাকতাড়ুয়া...

বৃক্ষের মাংসে অশ্লীল কুলকুচো
রক্তস্রাবে ভিজে আছে 
বনলতা সেন



আহরণ

জিব্রাইলের ডানা

শাহেদ আলী

আজিমপুর হয়ে যে রাস্তাটি সোজা পিলখানা রোডের দিকে চলে গেছে, তারই বাঁ-পাশে, গাছপালার ভেতর এগিয়ে গিয়ে একখানি ছোট্ট কুটির। ঘরের মেটে দেয়ালগুলোর উপরিভাগ গলে গেছে অনেক দিন রোদ-বৃষ্টি আর হাওয়ার অবারিত যাতায়াত এই ঘরের মধ্যে। মরচে-ধরা বহু পুরনো টিনের সুরাখ দিয়ে দেখা যায় নীল আসমানের ছিটেফোঁটা।

মা ও ছেলে শুয়ে আছে চাটাই বিছিয়ে।

সন্ধেবেলা হালিমা খুবই মেরেছিল নবীকে। আট বছর গিয়ে ন'বছরে পা দিয়েছে নবী। কাজ না শিখলে দিন গুজরানের উপায় থাকবে না। নবীকে দুধের বাচ্চা রেখেই বাপ তার ইন্তেকাল করেছে। একা হালিমা কী-ইবা করতে পারে তার জন্য? নিজের পেট পালতেই সাতবাড়ি ঘুরতে হয় তার; কাজ না পেলে ভিক্ষে করতে হয় এবং সন্ধেবেলা গিয়ে বসতে হয় গোরস্তানের গেটের কাছে। কবর জেয়ারত করতে এসে অনেকেই দান-খয়রাত করে, তাদের কাছ থেকে দু-চার পয়সা হালিমার বরাতে জুটে যায় কখনো কখনো। নবী অবশ্যি বিনে মাইনেই বিড়ির দোকানে কাজ করে, দোকানি শুধু দুপুরবেলা একবার খেতে দেয় নবীকে। এখনো সে পাকা হয়ে ওঠেনি বিড়ি বাঁধায়। কাজ সম্পূর্ণ শেখা হয়ে গেলেই সে মাস মাস পাঁচ টাকা করে পাবে দোকানির কাছ থেকে।

কিন্তু নবী ফাঁকি দিতে শুরু করেছে আজকাল, কোনো অছিলায় দোকান থেকে বেরিয়েই সে যে কোথায় চলে যায় কেউ বলতে পারে না। সন্ধে পর্যন্ত আর দেখাই মেলে না তার। এ নিয়ে দোকানের মালিক তিন দিন নালিশ করেছে হালিমার কাছে--আজ তাকে হুঁশিয়ার করে দিয়েছে, সে কাজ ছাড়িয়ে দেবে। নবীরঅমন দুষ্টু ছেলেকে দিয়ে দরকার নেই তার।

সারাটা বিকেল গোস্বায় আগুন হয়েছিল হালিমা--ছেলে যদি কোনো কাজ না শেখে, তার কি কোনো ভবিষ্যৎ আছে আজকের দুনিয়ায়? অথচ ছেলে এমনি মগড়া যে এদিকে মনই বসে না তার। মন বসবেই বা কেন? মা তো রয়েছে তার জন্য ভিক্ষা করতে--বাঁদিগিরি করতে! সন্ধেয় নবী বাড়ি ফেরার সঙ্গে সঙ্গেই হালিমা ধুম ধুম করে কতকগুলো কিল বসিয়ে দেয় নবীর পিঠে। সারাদিন কাটায় কোথায় নবী?--জানতে পীড়াপীড়ি করেছিল হালিমা, কিন্তু নবীর কাছ থেকে জওয়াব পাওয়া কঠিন, সে শুধু ফুলে ফুলে কেঁদেছে। কাঁদতে কাঁদতে না খেয়েই ঘুমিয়ে পড়ে নবী।

হালিমা খেতে বসেছিল, কিন্তু দু-এক লোকমা গিলেই সে উঠে পড়ে--তার পেটেও ভাত গেল না আজ! কত অনুনয়-বিনয় করেছে হালিমা, কিন্তু তাতে মন গলল না অভিমানী শিশুর, শুধু দু-একবার চোখ মেলে হালিমার দিকে তাকিয়েছিল। তারপর মুখ গম্ভীর করে সে নিজেকে সঁপে দেয় ঘুমের কোলে।

গলে যাওয়া দেয়ালের ওপর দিয়ে হালিমা তাকিয়ে আছে আসমানের দিকে। একটা হাত তার নবীর ওপর রাখা। নবীর পিঠে কঞ্চি ভেঙেও কোনোদিনই খুব ব্যথা পায় না হালিমা, কিন্তু আজ এই মুহূর্তে ঘুমিয়ে পড়া ছেলের ওপর হাত রেখেই তার মনটা হু হু করে ওঠে দুঃখে। সত্যি, এতটুকু ছেলে, কী-ইবা বোঝে? বাপ তো মরে গিয়ে রেহাই পেয়েছে চিরদিনর জন্য, বাপ-মার যুগল দায়িত্ব নিয়ে বেঁচে আছে হতভাগিনী হালিমা। এভাবে যখন-তখন ওকে মারপিট করা সত্যি অন্যায়। কিন্তু কাজ যদি কিছুই না শেখে, ও বাঁচবে কী করে সংসারে? হালিমা তো আর চিরদিন বেঁচে থাকবে না যে নিজের দিন-গুজরানের কথা নবীর না ভাবলেও চলবে।

হালিমার চোখ আঁসুতে ভরে আসে, আসমান থেকে নজর ফিরিয়ে নিয়ে সে চুমো খায় নবীর কপালে!

নবী আস্তে আস্তে চোখ মেলে চায়--আর হঠাৎ একবার দরজার দিকে আঙুল দেখিয়ে বলে ওঠে--মা, এইডা কে?

কই রে? বিস্মিত হালিমা প্রশ্ন করে।

উই যে গেল, ডান হাত বাড়িয়ে নবী দেখিয়ে দেয় অপরিচিতের যাওয়ার পথটি।

--কেউ না, নিঃসন্ধিগ্ধ উত্তর দেয় হালিমা।

--তুমি লুকাইবার চাও?--নবীর অভিমান যেন ফুলে ওঠে--খুব ছুন্দর একটা মানুছ গেছে না? রাঙা ধবধবা--আর পিন্দনে সুন্দর কাপড়?

--ছুন্দর মানুছ? হালিমার বিস্ময় এবার আরো বেড়ে যায়।

-- হ, চোখদুটো বড়ো বড়ো করে নবী বলে--মিঠাই লিয়া আইছিল--তোমার কাছে দিয়া গেছে না মা?

--হ, দিয়া গেছে, একটা করুণ হাসিতে প্রায় আর্তনাদ করে ওঠে হালিমা; তারপর একটু শান্ত হয়ে বলে, নবী এখন তুই ঘুমা--বিহান বেলা খাবিনে মিঠাই।

লোকটা কোনখান থেকে আইছিল মা? নবী আবার প্রশ্ন করে--দুইটা পাখনা দেখছ পিঠে?

পাখনা?--হালিমার আক্কেল সত্যি হার মানে এবার। আধো-আলো আধো-অন্ধকারের মধ্যে দৃষ্টিতে তীক্ষ্নতর করে সে তাকায় নবীর মুখের দিকে, কিছুই ঠাহর করে উঠতে পারে না হালিমা।

নবী আবার বলে--হ, পাখনা।--মউরের পেখমের মতো ছুন্দর।

হালিমা আরো কাছে টেনে নেয় নবীকে, পিঠের ওপর হাত বুলিয়ে দিতে দিতে বলে--ফিরিছতা আইছিল রে--ফিরিছতা। আজ ছবেবরাত না! ঘরে ঘরে আইয়া খোঁজ-খবর নিছে মানছের! ফিরিছতা গো আজ ছুটি।

ফেরেশতা এসেছিল! নবীর সারা গা রেমাঞ্চিত হয়ে ওঠে। এক দারুণ উত্তেজনায় সে উঠে পড়ে বিছানা ছেড়ে। রাতটা কী চমৎকার! রুপা-গলা জোছনায় ধুয়ে ঢল ঢল করছে সারা পৃথিবীর গা। সন্ধেয় ঘরে ফেরার সময় সে দেখেছে মসজিদে কোরআন-তেলাওয়াতরত ছেলেমেয়েদের। এখন রাত হয়েছে অনেক, তবু শাহ বাড়ির মসজিদ থেকে কোরআন তেলাওয়াতের শিরীন আওয়াজ ভেসে আসছে এখনো--গোরস্তান গমগম করছে মানুষে! আজ ঘুমিয়ে নেই কেউই, ফেরেশতার সঙ্গে, মৃতদের রূহের আজ মোলাকাত করবে সবাই, নিজেদের সুখ-দুঃখ, আশা-আকাঙ্ক্ষার কথা ফেরেশতা মারফত জানাবে আল্লাহর কাছে। শুধু নবী আর হালিমাই ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে নষ্ট করেছে এ সুযোগটা। তাদেরই দুয়ারের সুমুখ দিয়ে চলে গেছে আল্লাহর ফেরেশতা, অথচ তাদের চাওয়ার কথা--জীবন-পিপাসার কথা কিছুই জেনে যায়নি সে--কিছুই জানানো হলো না তাকে।

বাতি ধরিয়ে হালিমা পরীক্ষা করে ছেলের হাবভাব। একবার বলে--কিরে তোর খিদা লাগছে খুব? ভাত খাবি এখন? নবী কোনো জবাব দেয় না তার, খিদের কথা ভুলেই গেছে একদম। মন তার আচ্ছন্ন হয়ে আছে এক মধুর কঠিন ভাবনায়। ফেরেশতারা খবর নিয়ে যায় আল্লাহর কাছে। তাদের খবরও কি নিয়ে গেছে ফেরেশতা? সে কি গিয়ে বলবে না বরাতের রাতেও সে ঘুমে দেখে গেছে নবী আর হালিমাকে।

--ফিরিশতারে কিছু কইয়া দিছ মা? আবার জিজ্ঞাসু হয় নবী। কিছু বুঝতে না পেরে চুপ করে থাকে হালিমা।

--আরে পাগলা, হালিমা তার জ্বালা চেপে রাখতে পারে না।--ফিরিশতা আমাগো কতা ছুনবো ক্যান? বড়লোক গো খোঁজখবর করবার লাইগা আইছে! আমাগো দুয়ারের কাছ দে তাগো বাড়িই হে গেছে।

নবী চুপ করে থাকে অনেকক্ষণ, তারপর হঠাৎ প্রশ্ন করে--তুমি নামাজ পড়ো না ক্যান মা? অসহ্য মুরবি্বয়ানার সুর বেজে ওঠে তার প্রশ্নে।

--কী অইব নামাজ পইড়া? একটা পরম বিতৃষ্ণা প্রকাশ পায় হালিমার কণ্ঠে।

--কী, অইব কী? এতটুকু নবী জ্বলে ওঠে বিরক্তিতে, যারা নামাজ পড়ে তাগো বাড়িতেই না ফিরিছতারা আহে, আল্লাহ তো তাগো কতাই ছোনে।

--নারে না, হালিমা এক রকম চিৎকার করে ওঠে এবার, আল্লা তো ঘুমাইয়া রইছে কেঁতা গায় দিয়া। ছুনা-রুপা দিয়া ছেজদা করলেই হে চায়। গরিবের সোদা নামাজে হের মন ভেজে না।

আল্লাহর এই মহৎ গুণের কথা ভেবে একান্তভাবেই ঘাবড়ে যায় নবী। কাঙাল যারা, মিসকিন যারা, তাদের আর কোনো ভরসাই নেই তাহলে। এত সোনা-রুপাও তারা পাবে না, তাদের দিলের আরজুও গিয়ে পেঁৗছাবে না খোদার কাছে। আর তাই তো, গরিবদের যারা নামাজ পড়ে তাদের তো মালদার হতে দেখা যায় না; দুঃখ তাদের ঘুচছে কই?--সোনা-রুপার শিরীন আওয়াজেই তাহলে ঘুম ভাঙে খোদার! সে জন্যই বুঝি মালদাররা আরো মালদার হয়, এক গুণ দিয়ে পায় সত্তর গুণ।

কিন্তু খোদা তো পয়দা করেছেন সবাইকে। তিনি কেন তার রহমত একতরফা বিলিয়ে দেবেন মালদারদের মধ্যে? কোনোদিন কি ঘুমের ঘোরেও দরিদ্র বান্দার দুঃখে অশ্রুসিক্ত হয়ে ওঠে না তার চোখ? সত্যি কি গরিবরা ঘুম ভাঙাতে পারে না তার?

হতাশার আঁধারে হাতড়ে ফিরতে থাকে নবীর মন। দুয়ারের সুমুখ দিয়ে চলে গেছে ফেরেশতা, দবদবে আগুনের মতো রং, ময়ূরের পেখমের মতো বিচিত্র বর্ণের দুটো ডানা তার পিঠে, আর গায়ে সে কী খোশবু! সাদা ধবধবে তাজি ঘোড়া কোমর নাচিয়ে চলছে ফেরেশতাকে নিয়ে। নবী জেগে থাকলে আজ শুয়ে পড়ত ফেরেশতার পথে, আর মিনতি করে বলে যেত তার রক্তের ঢেউ ওঠা অফুরন্ত দুঃখের কাহিনী। কথা না শুনলে সে ঝুলে পড়ত ডানা ধরে-- ফেরেশতার সঙ্গে সঙ্গে উড়ে উড়ে সেও চলে যেত একেবারে আল্লার কাছে। অমনি চোখ মেলে নবী চিৎকার করত গলা ফাটিয়ে, খামচিয়ে রক্তাক্ত করে ঘুম ভাঙাত আল্লার!

কিন্তু তা তো আর হলো না। অথচ সব কিছুরই চাবি রয়েছে খোদার হাতে। তার ঘুম ভাঙাতে না পারলে কে-ইবা আর খুলে দেবে ভাগ্যের মণিকোঠা?

বিছানায় গিয়ে আবার শুয়ে পড়ে নবী। রাজ্যের যত চিন্তা এসে জটলা পাকায় তার মনে। হালিমাও বাতি নিভিয়ে গা এলিয়ে দেয় নবীর কাছে। ছেলে দু চোখ মেলে তাকিয়ে আছে বাইরের দিকে, হালিমা তো দেখছে না, শুধু বুক দিয়ে অনুভব করছে নবীর বুকভরা অস্বস্তি। একবার পিঠে হাত বুলিয়ে দিতে দিতে হালিমা বলে, নবী, অনেক রাত অইছে--তুই ঘুমা।

নবী আসমানের দিকে চেয়ে থাকে চুপ করে, আর একটা পথের খোঁজে কল্পনা তার হয়রান হয়ে যায়। আকাশ ভরে, পৃথিবী ভরে এত জোছনা--তবু যেন কত অন্ধকার, চোখের সঙ্গে মনও হারিয়ে যায় সে অন্ধকারে।

হঠাৎ একবার বিজলি ঝিলিক দিয়ে যায় তার চোখে, অকূল দরিয়ায় যেন নারিকেলকুঞ্জ-ছাওয়া উপকূলের আভাস পেয়েছে নবী। খুশিতে-আবেগে রোমাঞ্চিত হয়ে ওঠে তার সারা দেহ। হয়েছে, আর ভাবতে হবে না! আরশের পায়ায় রশি লাগিয়ে টান দেবে সে। রশি তো হাতেই রয়েছে তার। এবার থেকে নির্বিকার ভাব ঘুচে যাবে খোদার।

পরদিন। আগের দিনকার পানিভাত দুটো খেয়ে দোকানে কাজ করতে যায় নবী--যাওয়ার ইচ্ছে তার মোটেই ছিল না, হালিমাই তাকে পাঠিয়েছে অনেক শাসিয়ে। হালিমা বলে নিজের হাতে আজ গড়তে হবে কপাল, আল্লার কাছে আরজি পেশ করলেই চলবে না।

কয়েকটা ছেলের সঙ্গে নবী বিড়ি বাঁধছে; কিন্তু তার মন পড়ে আছে পিলখানার ওপাশে ফণিমনসায় ঘেরা নির্জন জায়গাটুকুতে। দোকান পালিয়ে লোকচক্ষুর আড়ালে ওইখানে সে রোজই ঘুড়ি ওড়ায় আপন মনে। এ খবর সে ছাড়া আর কেউ জানে না সংসারে। পৃথিবীকে লুকিয়ে শিশু তার কচি হাতদুটো বাড়িয়ে দেয় আসমানের দিকে। কিন্তু হাত আর কদ্দূরই বা ওঠে? নবীকে তাই নিতে হয়েছে ঘুড়ি--ঘুড়ি উড়িয়ে সে তার বাণী এত দিনে অজান্তে ওপর হতে আরো ওপরে আরশের দিকেই পাঠিয়েছে।

পেট ব্যথার অজুহাত তুলে নবী বেরিয়ে পড়ে দোকান থেকে। মুহূর্তের জন্যও সে স্থির হতে পারছে না আজ। অতি সন্তর্পণে বাড়ি পেঁৗছে নবী। মা বাড়ি নেই। আনন্দের সীমা থাকে না নবীর! তিনটা পাতিল তছনছ করে সে বার করে দু-আনা পয়সা--ওহ! দুই আনার পয়সা তো নয়, সাত রাজার ধন! পয়সাগুলো বার করে মুঠোয় পুরে নবী ছুটে যায় নবাবগঞ্জে। সুতো কিনে আবার সে দৌড়াতে শুরু করে দেয়। এক নতুন অভিযানের নেশায় বুক তার কাঁপছে। জঙ্গলের ভেতরকার এক পরিত্যক্ত ভাঙা মসজিদের অন্ধকার গুহা থেকে বের করে একটা ঘুড়ি আর লাটাই। এই ঘুড়ি তাকে রোজ বের করে আনে কাজ ভুলিয়ে, এই ঘুড়িই তাকে পৃথিবীর সীমানা ছাড়িয়ে আসমানের পথে নিয়ে যায়। আর সব ব্যাপারেই খই ফোটে নবীর মুখে, কিন্তু এই ঘুড়ির কথা কারো কাছে সে বলে না। এ যেন তার নেহাত পুশিদা খেলা, একান্তভাবেই নিজস্ব।

একসময় নবী চলে যায় পিলখানার ওপাশে সেই ফণিমনসায় ঘেরা নির্জন জায়গাটুকুতে। পুরনো সুতোটার সঙ্গে নতুন সুতোটা গেরো দিয়ে সে ঘুড়ি উড়িয়ে দেয় আসমানে। ঘুড়ি যতই ওপরে উঠতে থাকে উল্লাস-অধীরতায় ততই বিচলিত হয়ে ওঠে নবী, একটা স্মিতহাস্য তার মুখ থেকে চোখ পর্যন্ত ঝিলিক দিয়ে ওঠে বারবার। আরশের পায়ে রশি লাগিয়ে আজ সজোরে টান দেবে নবী।

ক্রমইে ছোট হয়ে আসে ঘুড়িটা। একসময় যখন হাতের সুতো শেষ হয়ে গেল, নবীর দুঃখের সীমা থাকে না। সুতো শেষ হয়ে গেছে কিন্তু ঘুড়ি যে দেখা যাচ্ছে এখনো। খোদা কি এত কাছে? তা তো নয়, মানুষের দৃষ্টিসীমার বাইরে অনেক-অনেক দূরে আরশের ওপর ঘুমিয়ে আছেন তিনি। এত কাছে হলে তো খালি চোখেই দেখা যেত আল্লাকে। সুতো চাই তার আরো, অনেক সুতো--যেন তার ঘুড়িকে নিয়ে যায় মেঘের ওপারে, আরশের একেবারে কাছটিতে। কিন্তু এখানেও দরকার পয়সার। সে যে সুতো কিনবে সে পয়সাই বা কই নবীর? তাদের দুর্দশা তাহলে আর ঘুচবে না। নবী আসমানের দিকে চেয়ে নিজের ব্যর্থতায় আর্তনাদ করে ওঠে। ঘুড়ি ওড়ানো যতদিন একটা শখ ছিল, নেশা ছিল, ততদিন শুধু ঘুড়ি উড়িয়েই আনন্দ পেয়েছে। কিন্তু আজ যখন এই ঘুড়ি একটি গভীর অর্থ নিয়ে তার কাছে ধরা দিয়েছে সহস্র বেদনার সম্ভাবনার পথও অবারিত হয়ে গেছে তার জন্য।

কিছুক্ষণ ঘুড়ি উড়িয়েই বাড়ি চলে আসে নবী। এই সুতোয় হবে না, আরো আরো অনেক সুতো চাই। বামনের হাত বাড়িয়ে আরশের পায়া ধরা অসম্ভব। পরম যত্নে সে ঘুড়িটা লুকিয়ে রাখে ভাঙা মসজিদের অন্ধকারে।

বেলা চলে যাচ্ছে, ঘরেও পয়সা নেই। মার কাছে পয়সা চাইতে গেলে হালিমা কঞ্চি দিয়ে তার পিঠের ছাল না তুলে ছাড়বে না। যে দুই আনা পয়সা আজ সে চুরি করেছে, তার জন্যই তার বরাতে কী আছে, কে জানে? তবুও লোভ সামলাতে পারে না নবী। আজলের লেখা পাল্টাতে হলে কিছু খরচ-কিছু ক্ষতি স্বীকার করতে হবে বৈ কি। মার অবর্তমানে নবী উল্টেপাল্টে দেখে ঘরের সব কটা হাঁড়ি-পাতিল, ছেঁড়া কাপড়ের বোচকাগুলো খোঁজে তন্ন তন্ন করে। একটা পয়সা নেই কোথাও। পয়সা থাকবেই বা কী করে? ভিক্ষা করে, পরের বাড়িতে কাজ করে যা দু-চার পয়সা পায় তাতে করে মা-ছেলের আধপেটা খাবারই হয় না কোনোদিন, তারা আবার জমাবে পয়সা!

হঠাৎ নবীর মনে পড়ে, ইস্টিশনে গেলে দু-চার পয়সা পাওয়া যেতে পারে। তার বয়সের ছেলেদের সে কুলিগিরি করতে দেখেছে অনেকদিন। নবী আর ভাবতে পারে না, একপেট খিদে নিয়েই সে ছুটে যায় ইস্টিশনের দিকে। অনেকক্ষণ বসে থাকতে হয় তাকে! তারপর গাড়ি যখন এলো, তাজ্জব বনে যায় নবী--কত বিচিত্র রকমের মানুষ, আর কত রংবেরঙের পোশাক। বাক্স-বিছানা, পেটরা প্রভৃতিতে স্তূপীকৃত হয়ে ওঠে লাইনের কাছটুকু।

'মুটে চাই'--চিৎকারে হারিয়ে যায় আর সব আওয়াজ।

সবার বরাতেই একটা-না-একটা কিছু জুটে যায়; কিন্তু নবীর কপাল বড় খারাপ, 'মুটে চাই' বলে চিৎকার করতে গিয়ে আওয়াজ এলো না তার গলায়--হাত দুটো চাওয়ার ভঙ্গিতে ওপর দিয়ে উঁচিয়ে সে ছুটে যায় এক কামরার সুমুখ থেকে আরেক কামরার সুমুখে--চোখ তার করুণ আঁসুতে টলমল। ভিক্ষুক মনে করে কেউ কেউ তাকে নসিহত করল শ্রমের মর্যাদা সম্বন্ধে, আর অতি আধুনিক কেউ কেউ দিল গলাধাক্কা। কারো কাছ থেকেই নবী কিছু পেল না।

ট্রেন চলে গেছ। ইস্টিশনে বসে বসে নিজের বদনসিবের জন্য বেদনায় ভরে আসে নবীর মন। দুঃখটা এবার আরো বড় হয়ে দেখা দেয় নবীর কাছে। মায়ে-বেটায় কোনোদিন একবেলা পেট ভরে খেতে পায় না তারা। কোনোদিন একেবারে উপোস করতে হয় তাদের। বছরে একবার করেও যদি কাপড় কিনতে পারত তারা! সেই তার বাপ ছেঁড়া শততালি দিয়ে যে কাপড়গুলো রেখে গিয়েছিল, সেগুলোই আরো তালি দিয়ে এবং গেরোর ওপর গেরো দিয়ে পরছে তারা দুজনে। ঘরের মেটে দেয়াল তো প্রায় সবটাই গলে গেছে, বৃষ্টি হলেই টিনের সুরাখ দিয়ে 'উসলিয়া' পড়ে পড়ে ঘর ভেসে যায় পানিতে। দুর্দশার আর সীমা-পরিসীমা নেই তাদের। আল্লার কাছে তাদের দিলের আরজ পেঁৗছাতে পারলেই অবসান ঘটত দুঃখ-রাত্রির। কিন্তু হালিমা নামাজ পড়ে না, নবীও আরবি সুরা এবং রাকাতগুলো শেখার সুযোগ পায়নি কখনো। আল্লা কেন-ইবা শুনবেন তাদের কথা।

ঘণ্টাখানেক পরে আর একটা ট্রেন যখন এলো, নবীর আনন্দ দেখে কে! ট্রেন থামার আগেই 'মুটে চাই'-'কুলি চাই' বলে সে চিৎকার শুরু করে দেয় প্রাণপণে। ট্রেন থামলে একটা ঘড়ি পরা বলিষ্ঠ হাতের ইশারায় নবী এসে দাঁড়ায় এক প্রথম শ্রেণীর কামরার সুমুখে। ভদ্রলোক একটা অ্যাটাচি ও হোল্ডঅল দেখিয়ে দিয়ে বললেন--ওয়েটিং রুমে নিতে পারবি?

--ক্যান্ পারুম না? তাচ্ছিল্যের সঙ্গে জবাব দেয় নবী, দেন আমার ঘাড়ে তুইলা।

--কত নিবি? ভদ্রলোকের ঠোঁটে মৃদু হাসি ফুটে ওঠে।

--আমার বহুত পইছার দরকার, চোখ দুটো বড় বড় করে উচ্চারণ করে নবী--আপনে কত দিতে পারবেন?

ভদ্রলোক এবার দৃষ্টি প্রখরতর করে নবীর মুখের দিকে তাকান; অদ্ভুত ছেলে তো! বলেন--এত পয়সা দিয়ে কী করবি?

--বারে, পইছার বুঝি কাজ নাই। নবী রীতিমতো বিস্ময় প্রকাশ করে, ঘুড়ির রছি কিনুম যে--অনেক রছি।

ভদ্রলোক এবার সত্যিই হেসে ফেলেন এবং হোল্ডঅলটা নবীর মাথায় দিয়ে অ্যাটাচিটা হাতে করে নেমে পড়েন গাড়ি থেকে; ওয়েটিং রুমে এসে চার পয়সার জায়গায় চার আনা দিয়ে বলেন--এই নে, অনেক সুতো হবে।

নবী সিকিটা ছুড়ে মারে ওয়েটিংরুমের মেঝেয়--না, আমি নিমু না। চার আনায় আমি কী করুম? আমার অনেক রছি লাগব। আমার ঘুড়ি আছমান ছুঁইব গিয়া।

সবাই অবাক হয়ে যায় নবীর মেজাজ দেখে। ভদ্রলোক সিকিটা হাতে নিয়ে হাসতে হাসতে বলেন--ঘুড়ি আসমান ছুঁলে তোর কী হবে?

--ক্যান্, আরছের পায়ায় বাঁধাইয়া টান দিমু, এক স্বপি্নল নেশা আর শক্তির স্ফূর্তিতে নবী মুহূর্তে যেন বিরাট কিছু হয়ে ওঠে--আল্লা খালি আপনাগো কতাই ছুনব, আমাগো কতা বুঝি ছুনোন লাগব না হের?

এবার সবাই এ-ওর মুখ চাওয়াচাওয়ি করতে থাকে। পরিবেশটা মূহূর্তে যেন কেমন থমথমে বিষণ্ন হয়ে ওঠে। কারো মুখে টু শব্দটি নেই। রাজভক্তদের সামনে যেন রাজদ্রোহের বাণী উচ্চারিত হয়েছে শিশুর মুখে। ভদ্রলোক পকেট হতে একটা আধুলি বের করে বলেন--এই নে, এখন হবে তো?

আধুলিটা হাতে নিয়ে কৃতজ্ঞতায় আঁখি ছলছল করে ওঠে নবীর। আন্তরিকতা মিশিয়ে বলে, আমাগো যখন অনেক পইছা অইব, আমাগো বাড়ি তখন আইয়েন--আপনের জেব ভইরা দিয়া দিব হেদিন।

নবীর কথায় হেসে ফেলে সবাই। যিনি আধুলিটা দিয়েছেন তিনি তো উচ্ছ্বসিত হয়ে উঠলেন হাসিতে। তাঁর আজকের এই মেহেরবানির কথা ভুলতে পারবে না নবী--দিন যখন ফিরবে, নবী দুই জেব ভর্তি করে পয়সা দিয়ে শোধ করবে তাঁর ঋণ। হাসতে হাসতেই বলেন, হ্যাঁ, হ্যাঁ, নিশ্চয়ই আসব, আমরা সবাই আসব সেদিন।

নবী এসব শোনার জন্যে অপেক্ষা করে না। সে সোজা চলে যায় চকের দিকে। অনেকটা সুতো কিনে যখন বাড়ি ফিরল তখন সন্ধ্যা মিলিয়ে গেছে। সুতোটা সে লুকিয়ে রেখে আসে মসজিদে--তার ঘুড়ির পাশে।

হালিমা ভিক্ষা করে আনা চালগুলো জ্বাল দিচ্ছে আর সুরবুর হচ্ছে ধুয়োয়। গাছতলা থেকে ভিজে বন কুড়িয়ে এনেছে আগুন ধরাবার জন্যে, নবীকে দেখেই চোখ কচলাতে কচলাতে বলে--কিরে, অতোক্ষণে কোত্থে আইলি?

মার দরদভরা প্রশ্নে অত্যন্ত খুশি হয় নবী; তার মেজাজ তাহলে বিগড়ে যায়নি আজ। হয়তো পাতিল তছনছ করে পয়সা নেওয়ার খবরটি সে জানতেই পারেনি এখনো। মনে মনে আল্লাকে সে শুকরিয়া জানায়।--দোকান তে বার অইয়া একটু ঘুইরা আইলাম, মা। মার দিকে চেয়ে সে বলে সহজভাবে!

চুলোয় বন ঠেলতে ঠেলতে হালিমার কণ্ঠে দরদ ভেঙে পড়ে--দোকান তে পালাস নে যেন!--কাজটা ছিখে ফেললে অনেক পইছা আইব ঘরে--কাজ না জানলে কি আর ভাত-কাপড় জুটে?--আমাগো মা-পুতের কি এ ছাড়া আর উপায় আছে?

এবার ছেলের মুখের দিকে চেয়ে হালিমা প্রশ্ন করে--হারে নবী, তোর খিদা লাগছে না?

মায়ের আন্তরিকতায় নবী এক রকম ভুলেই যায় তার খিদের কথা। তা ছাড়া একদিকে রশি কেনার আনন্দ, অন্যদিকে মার স্নেহ--দুটোতে মিলে আজকের দিনটি অপূর্ব হয়ে উঠেছে নবীর কাছে। হেসে সে বলে--না, মা, আমার খিদা লাগছে না। দোকানে আমাগোরে খাওয়ায় কিনা দুপুরবেলা।

--তাই ভালা, হালিমা সায় দেয়--ভিক্ষার ভাত যত কম পেটে দেওয়া যায় ততই ভালো। এ ভাতে ছেলে-মাইয়া গো বাইড় থাকে না।

রান্না হলে নবী ও হালিমা, দুজনেই কিন্তু ভিক্ষার ভাত পেটে ঢেলে স্বস্তিবোধ করে কিছুটা।

পরদিন দোকানের কথা বলে নবী একটু সকাল সকালই বেরিয়ে পড়ে ঘর থেকে। আজ আবহাওয়া খুবই অনুকূল এবং নবীর হাতে অনেক সুতো। পৃথিবীতে দাঁড়িয়ে অনায়াসে আজ সে তার হাত পৌঁছে দিতে পারবে আসমানে।

নবী ঘুড়িটাকে পয়লা বুকের কাছে চেপে ধরে--বুক তার টিপটিপ করছে। কিছুক্ষণ পরেই ঘুড়ি উড়ল আসমানে, হাওয়ার ভরে নেচে নেচে দুঃসাহসের দোলায় কেঁপে কেঁপে ঘুড়ি উঠে যায় ওপর হতে ওপরে--আরো ওপরে--সুতো আজ ফুরোতে চায় না--ঘুড়ি ক্রমেই ছোট হয়ে আসছে--অই বুঝি ঘুড়ি হারিয়ে যায় দৃষ্টির ওপারে, অসীম শূন্যতায়!

আবেগে, ঔৎসুক্যে, বড় হয়ে এলো নবীর চোখ দুটো। তার বুকের শ্বাস দীর্ঘ হতে দীর্ঘতর হয়ে আসে, ঠোটের বাঁধন খুলে গিয়ে একটা অদ্ভুত হাসির আমেজ লাগে তার সারা মুখে। ঘুড়ির নাচের সঙ্গে একটা অপূর্ব চঞ্চলতায় নাচতে থাকে তার বড় হয়ে আসা চোখের চকচকে তারা দুটো।

একসময় টের পায় নবী--লাটাই আর ঘুরছে না--সুতো শেষ হয়ে গেছে। সেই নির্জন ফণিমনসায় ঘেরা জায়গাটুকুতে নবীর চোখ পানিতে ভরে আসে। ঘুড়ি এখনো দৃষ্টিসীমার ভেতরেই।

নবী ঘুড়ি নামিয়ে আনল। আরো রশি চাই তার--অনেক রশি। খোদা তাঁর আসন এত দূরে পেতেছেন কেন? বুঝতে পারে না নবী। কিন্তু আসন দূরে পাতলেই কি আরশে বসে ঘুমানো এত নিরাপদ? সংসারে কি রশি নেই যে তার আরশ ছোঁওয়া যাবে না, টলিয়ে দেওয়া যাবে না পায়ায় রশি লাগিয়ে? নবীর আকাঙ্ক্ষা আরো প্রবল হয়ে ওঠে বাধা পেয়ে।

চিরদিনকার মতো মসজিদে ঘুড়ি আর লাটাই লুকিয়ে রেখে, আজও সে চলে ইস্টিশনে! পয়সা চাই তার, রশি কেনার পয়সা--যে রশি সে আরশের পায়ায় বেঁধে খোদাকে নামিয়ে আনবে মাটির মানুষের মধ্যে!

শেষ পর্যন্ত দুই আনার বেশি আর জুটে না। কতটুকু সুতোই বা আর কেনা যায় এ দিয়ে।

এমনি করে রোজ কিছু কিছু পয়সা আয় করে নবী--আর তাই দিয়ে সুতো কিনে পুরনো সুতোটার সঙ্গে জুড়ে দিয়ে ঘুড়ি উড়িয়ে দেয় আসমানে।

হালিমা নবীর এ কথায় সায় দিতে পারত না কোনোদিনই। কিন্তু এই মুহূর্তে সে সায় না দিয়ে পারে না। নবীর চোখে যেন সে পরিচয় পেয়েছে--তাদের উজ্জ্বল ভবিষ্যতের।

জমিদারবাড়ির দেওয়া পয়সা আর চালে দুদিন ভালোই যায় তাদের। আবার শুরু হয় আধপেটা খাওয়া আর উপোসের পালা। নবীর মন ভেঙে পড়ে--রাগে জ্বালা ধরে যায় তার সমস্ত সত্তায়। একি ছলনা--একি ছিনিমিনি খেলা বান্দার জীবন নিয়ে? তাদের আরজ তাহলে এখনো গিয়ে পেঁৗছায়নি খোদার কাছে!

নবী রোজ ঘুড়ি ওড়ায় আর মনে মনে বলে--আল্লাহর আরশ পর্যন্ত পেঁৗছতে পারে এত সুতো যদি সে কিনতে না-ই পারে, এত ফেরেশতা রয়েছে কী জন্য? তারাই তো মানুষের দিলের আরজ পেঁৗছায় নিয়ে খোদার কাছে। তাঁর কাছ থেকে তারাই তো পয়গাম নিয়ে আসে মানুষের কাছে! আজকাল এত নিষ্ক্রিয় কেন এই ফেরেশতারা? কেন তারা নবীর ঘুড়িকে নিয়ে যায় না আল্লাহর কাছে?

সেদিন সোমবার। নবী না খেয়েই ঘুড়ি আর লাটাই নিয়ে বেরিয়ে পড়ে চুপিচুপি। সেই ফণিমনসায় ঘেরা নির্জন জায়গাটুকু। নবী দুর্বার ওপর বসে নতুন সুতোটাকে জুড়ে দেয় পুরনো সুতোটার সঙ্গে। আসমান কেমন যেন মেঘলা মেঘলা। সূর্যের আলো পরে মেঘগুলো সাদা হয়ে গেছে আর ফাঁকে ফাঁকে চকচক করছে গাঢ় নীল আসমান। একসময় নবী ঘুড়িটাকে উড়িয়ে দেয় আসমানে--হাতে তার লাটাই ঘুরছে আর শনশন করে ধাওয়া করছে ঊর্ধ্বদিকে। নবী অপলক চেয়ে আছে ঘুড়ির পানে, আর রশিতে টান পড়ে পড়ে ঝিনঝিন করে উঠছে তার সারা শরীর। অকারণ উল্লাসে ভরে উঠছে নবীর মন! নবী কিছুই বুঝে উঠতে পারে না! মন তার আবেগে-উৎসাহে থরথর করে কেঁপে উঠছে, কল্পনা স্বর্ণ-ঈগলের মতো ডানা মেলেছে আসমানে!

ঘুড়ি ক্রমেই ছোট হয়ে এলো! একসময় নবী বিস্মিত হয়ে দেখতে পায়, তার ক্ষুদ্র ঘুড়িটার চারপাশে একটা বৃহৎ পাখি উড়ছে আর ঘুরছে। মাঝেমধ্যে পাখিটা হারিয়ে যাচ্ছে মেঘের আড়ালে, আবার দেখা যাচ্ছে। বৃহৎ ডানা মেলে ঘুরছে ঘুড়িটাকে কেন্দ্র করে আশ্চর্য, একবার ঘুড়ির রশি আটকে যায় পাখির গায়, নবীর হাতে টান পড়ে আর তাতেই সারা দেহ অজানা আশঙ্কায় দুলে ওঠে--পাখিটা ঘুড়ি নিয়েই ঘুরতে থাকে আরো দ্রুতবেগে। রশি আরো প্যাঁচ খেয়ে লাগে পাখির ডানায় আর গায়ে। হঠাৎ একসময় নবী টের পায়, সুতো ঢিল হয়ে গিয়ে নেমে আসছে আর ঘুড়ি ঘুরছে পাখির পিছে পিছে। নবীর এতদিনের অহংকার মাটি হয়ে যায় আজ! আরশের পায়ায় রশি লাগিয়ে আরশকে টলিয়ে দেওয়া আর সম্ভব হলো না জীবনে!

একাকী শূন্য মাঠে ডুকরে কেঁদে ওঠে নবী। দুই চোখ ভরা আঁসু নিয়ে একবার সে তাকায় ঘুড়ির দিকে। একটা কালো বিন্দুর মতো পাখির পিছে পিছে ঘুরছে ঘুড়ি; আর পাখিটা শুধু ঘুরে ঘুরে ওপরের দিকেই উঠছে। আচমকা নবীর মনে হলো--এ তো পাখি নয়--এ যে ফেরেশতা--জিবরাইল এসেছে পাখির সুরত ধরে তার ঘুড়িকে আল্লার কাছে নিয়ে যাওয়ার জন্যে! দুই চোখ ফেটে এবার কৃতজ্ঞতার আঁসু গড়িয়ে পড়ছে নবীর গাল বেয়ে; তার আঁসু ধোয়া মুখে ফুটে ওঠে একটা অপূর্ব হাসি--বেদনা আর আনন্দে ঝলঝল করা।

নিজের বোকামির কথা ভেবে শরম হয় নবীর। এতদিন পরে ফেরেশতা এসেছে তার দিলের আরজ আল্লার কাছে নিয়ে যাওয়ার জন্য! আর সে কি না কাঁদছে পাখি তার ঘুড়ি নিয়ে গেল বলে! চোখ মুছে সে তাকায় আসমানের দিকে--দেখে পাখিও নেই--ঘুড়িও নেই, শুধু সাদা মেঘ, আর তারি ফাঁকে ফাঁকে চকচক করা গাঢ় নীল আসমান! অনেকক্ষণ নবী চেয়ে থাকে আসমানের দিকে, আবার তার চোখ ফেটে দরদর করে বেরিয়ে আসে কৃতজ্ঞতার আঁসু। আজকে সে সার্থক--আজকে সে জয়ী! আর কোনো ভাবনা নেই তার, জিবরাইল এসে নিয়ে গেছে তার ঘুড়ি--নতুন পাতা খুলবে এবার জীবনের।

আবার আসমানের দিকে চেয়ে, এক ঝলক হেসে নবী বাড়ি ফিরে আসে। খুশিতে তার সারা শরীর আজ নেচে উঠছে। হালিমা উঠানে বসে শাক বাছছিল। 'মা-মা--হুনছ' বলে নবী ঝাঁপিয়ে পড়ে হালিমার কোলে।

হালিমা হঠাৎ গম্ভীর হয়ে পড়ে--তারপর রাগে ঠোঁট কামড়ে; টিপে ধরে নবীর ঘাড়--গরগর করে বলে--কোত্থে আইলিরে হারামজাদা? আইজ তোর রং আমি না বাইর কইরা ছাড়ুম না!

নবী তার মার রাগের কারণ বুঝতে পারে না, তবু তার খুশির খবরটুকু সে না দিয়ে পারছে না তার মাকে--মা আইজ জিবরাইলরে দেখছি--আমগো খবর...

নবী কথা শেষ করতে পারে না--ধুম ধুম করে হালিমার শক্ত হাতের কিল পড়তে থাকে তার পিঠে। কিলোতে কিলোতেই বলে--ওরা দিব আর আমরা খামু বইয়া বইয়া? ঝাঁটা মার জিবরাইলের মুখে শতবার!

--মা মা--তুমি গাল দিও না, চিৎকার করে ওঠে নবী--গুনা অইব মা, আল্লা রাগ করব।

হালিমার রাগ আরো বেড়ে যায়--গালের ফোয়ারা থামতে চায় না তার। নিরুপায় নবী কামড়ে ধরে তার মায়ের হাত।

এবার যেন আগুন লেগে যায় হালিমার গায়। বিড়ির দোকানে মালিক আজকে বলে গেছে--নবী দোকানে যায় না কোনোদিনই; সুতরাং কাজ তার ছাড়িয়ে দেওয়া হলো আজ থেকে। দোকানির কাছেই শুনেছে হালিমা--নবী নাকি কোথায় ঘুড়ি উড়ায় সারাদিন, আর সময় সময় ছুটে বেড়ায় বাজারে, আর ইস্টিশনে। খবরটা পেয়ে অবধি গোস্বায় আগুন হয়ে ছিল হালিমা। এমন অবাধ্য শয়তান ছেলেকে দিয়ে কাজ কী? হালিমা এবার কঞ্চি হাতে নিয়ে সপাং সপাং মারতে থাকে নবীর পিঠে, হাতে, মাথায়।--হারামজাদা, তোর ভালার লাইগাই না আমার মাথা-বিষ, আর তুই কি না ফাঁকি দেছ আমারে! আমি মরলে জিবরাইল খাঞ্চা খাঞ্চা ভাত লইয়া আইব না তোর লাগি।

আঘাতে আঘাতে ক্ষতবিক্ষত হয়ে যায় নবীর পিঠ--চিৎকার করে সে কাঁদে এবং কামড়ে রক্তাক্ত করে দেয় হালিমাকে। একসময় প্রায় বেহুঁশ হয়ে সে লুটিয়ে পড়ে মাটিতে।

রাতের বেলা হালিমার গায়ে জ্বর এসে যায়। নবী তার মার দিকে একবার চায় এবং কিছু না বলে ঘরের এক কোণে শুয়ে পড়ে মাটির ওপর। কিছুই পেটে পড়ল না তার। শুয়ে শুয়ে, কপাল কুঁচকে ঠোঁট ফুলিয়ে সে কটমট করে। তাকিয়ে থাকে হালিমার দিকে।

তারপর, কখন যে সে ঘুমিয়ে পড়ল, সে নিজেই জানে না।

ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে নবী স্বপ্ন দেখল, জিবরাইল তার ঘুড়ি নিয়ে মেঘের ফাঁকে ফাঁকে আসমানের দিকে ধাওয়া করছে। একসময় নীল আসমান দুদিকে সরে গিয়ে পথ করে দিল জিবরাইলের জন্য। মেঘের ফাঁকে ফাঁকে আবার যাত্রা শুরু হলো আবার একটা আসমান ফাঁক হয়ে গে আবার আরেকট ষষ্ঠ আসমান খোলার সঙ্গে সঙ্গে আগুন লেগে গেল জিবরাইলের ডানায়। জিবরাইল তবু এগোচ্ছে নবীর ঘুড়ি নিয়ে! তারপর একসময় খুলে গেল সপ্তম আসমানের দরজা আর তার ফাঁক দিয়ে একটা তীব্র আলোকচ্ছটা এসে ঝলসে দিল নবীর চোখ দুটোকে। আর চাইতে পারল না নবী দুই চোখে হাত দিয়ে চিৎকার করে ওঠে ঘুমের ঘোরে মাগো, আমার চোখ দুইটা পুইড়া গেল!

চোখ কচলাতে কচলাতে উঠে বসে নবী গলে যাওয়া দেয়ালের ওপর দিয়ে সূর্যের প্রখর আলো তার নাকে-মুখে এসে লাগছে।

#একটি অসাধারণ গল্প শেয়ার করলাম। " আহরণ" বিভাগে এ ভাবেই তুলে ধরা হবে এমন কিছু মণি মাণিক্য ---সম্পাদক



সম্পাদক - বিশ্বরাজ ভট্টাচার্য 
৯৪৩৫৬১৫২৫৯
im.biswaraj@gmail.com